লোডিং... Loading.....................!

img
হোম
ব্লগ
সর্বাধিক পঠিত
সর্বাধিক আলোচিত
অনলাইনে আছেন
লগইন
রেজিস্ট্রেশন
মেনু বন্ধ করুন

মেনু বন্ধ করুন
img

শর্মিলা ঠাকুর

কলম উত্তম তারিখঃ নভেম্বর ৮, ২০১৮ (বৃহস্পতিবার), ১১:৩০
  • ৩২৬৪
  • ০
  • ০
  • ০

৭ নভেম্বর নিয়ে কিছু কথা



৬ নভেম্বরের মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসে একদল সৈন্য অস্ত্রাগারের কপাট খুলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সূচনা করে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’। অনুঘটকের কাজটি করেছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এটি ছিল প্রথাবিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদের একটি সংগঠন। বলা চলে সেনানিবাসগুলোতে জাসদের শাখা বা অঙ্গসংগঠন। সৈনিকদের সংগঠিত করার কাজটি শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। এর ধারণাগত ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় জাসদ তৈরি হওয়ার আগেই। বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের ওপর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ২০ অক্টোবর ১৯৭২ সাবেক ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের নামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘প্রতিরক্ষা বিষয়ে ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো পেশাদার সেনাবাহিনী বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দেশরক্ষা বাহিনী জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল এবং যে দেশ সমাজতন্ত্রমুখী, সে দেশে পেশাদার সেনাবাহিনী না রেখে “পিপলস আর্মি” গঠন করাই বেশি যুক্তিসংগত।’ (গণকণ্ঠ, ২১ অক্টোবর ১৯৭২)। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ জাসদের জন্মমুহূর্তে ‘সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সকল প্রকার পন্থা অবলম্বন করার’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল (গণকণ্ঠ, ১ নভেম্বর ১৯৭২)।

মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মো. আবদুল জলিল সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে জাসদে যোগ দিয়েছিলেন। সেনাছাউনিগুলোতে সৈনিকদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজটি তিনিই শুরু করেন। সশস্ত্র বাহিনীর নন-কমিশন্ড ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসাররাই ছিলেন মাঠপর্যায়ের সংগঠক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন করপোরাল আলতাফ হোসেন, নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, নায়েব সুবেদার বজলুর রহমান, নায়েব সুবেদার মাহবুবুর রহমান, নায়েব সুবেদার জালাল, নায়েক আবদুল বারী, হাবিলদার আবদুল বারেক প্রমুখ।

১৭ মার্চ ১৯৭৪, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে মেজর জলিলসহ কয়েকজন জাসদ নেতা গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে চিঠি পাঠিয়ে জলিল সামরিক বাহিনীতে যাঁরা সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলেন। তাহের সেনাবাহিনী ছেড়ে এলেও সরকারি চাকরিতে বহাল ছিলেন এবং গোপনে জাসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এরপর জাসদের পক্ষ থেকে সৈনিক সংস্থার দেখভাল তিনিই করতেন।

সেনাবাহিনীতে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এবং জিয়ার প্রশ্রয়ে সৈনিক সংস্থা বিস্তৃতি লাভ করেছিল। জিয়ার মধ্যে সেনাপ্রধান হতে না পারার ক্ষোভ ছিল। উচ্চাকাঙ্ক্ষী জিয়ার পক্ষে তাহের খুব ভালোভাবেই জিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল সাধারণ সৈন্যদের সংগঠিত করতে পেরেছিলেন।

এঁদের একটা ছোট অংশ জাসদের রাজনীতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল। তাঁরা ‘সামাজিক বিপ্লবের’ একটা ধারণা লালন করলেও বেশির ভাগ সৈন্য ছিল এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী, তথা আওয়ামী লীগ ও তার নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের ঘোর বিরোধী। সেনাবাহিনীর রাজনীতিকীকরণ শুরু হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। সৈনিক সংস্থা এই রাজনীতিকীকরণকে আরও উসকে দেয়।

আবু তাহেরকে নিয়ে পরে অনেক গল্প তৈরি হয়েছে। তিনি সৈনিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নন। ১৯৭৩ সাল থেকেই জাসদ নেতৃত্ব একটা ‘বিপ্লবী পার্টি’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় চুয়াত্তরের জুনে ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি চলছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম। জাসদের বিকাশমান বিপ্লবী পার্টির কার্যক্রমের দায়িত্ব একেকজনের ছিল একেক রকম। তাহের সেনাবাহিনীর কাজটি দেখভাল এবং জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন। দলের সুপ্রিমো ছিলেন সিরাজুল আলম খান।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে জিয়া সেনাপ্রধান হন। কিন্তু একচ্ছত্র ক্ষমতা তিনি পাননি। জিয়া তখনই রাষ্ট্রপতি হতে উন্মুখ ছিলেন এবং তাহের এ জন্য ফারুক-রশিদের কাছে দেনদরবারও করেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ওই সময় জাসদের প্রধান নেতারা হয় জেলে, নয়তো ঢাকা কিংবা দেশের বাইরে। তাহেরের হাতে জাসদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে যায়। তিনি অনেক বিষয়েই জাসদের রাজনৈতিক ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন।

৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের কারণে মোশতাক-জিয়া চক্রের বিরুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। অসামরিক নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক সরকার যাতে গঠিত না হতে পারে সে জন্য চারজন জাতীয় নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। সেনানিবাসগুলো অস্থির হয়ে পড়ে। জাসদ এই সুযোগটা নিতে চেয়েছিল। ষাটের দশকের গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির উত্তরাধিকার বহনকারী জাসদের মূল নেতৃত্বের চিন্তায় তখনো কাজ করছে ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭১-এর গণসংগ্রামের মডেল। সিদ্ধান্ত হলো ৯ নভেম্বর থেকে লাগাতার হরতাল হবে এবং ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে শ্রমিকদের জড়ো করে ঢাকায় ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সৃষ্টি করতে হবে।

৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় বসল জাসদের বিপ্লবী পার্টির ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা। হঠাৎ করেই সেখানে তাহের এসে উপস্থিত হন এবং ঢাকা সেনানিবাসে নিজ গৃহে অন্তরীণ জিয়ার হাতের লেখা একটা চিরকুট পড়ে শোনান। চিরকুটটা ইংরেজিতে। বাংলা তরজমা করলে তার অর্থ হবে—আমি বন্দী, নেতৃত্ব দিতে পারছি না। আমার লোকেরা তৈরি। তুমি যদি নেতৃত্ব দাও, আমার লোকেরা তোমার সঙ্গে যোগ দেবে।
(সূত্র: জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা প্রকাশন)।

তাহের প্রস্তাব দেন, জিয়াকে সামনে রেখে অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় সভায় উপস্থিত জাসদ নেতারা বেশ বেকায়দায় ছিলেন। তাঁরা একপর্যায়ে তাহেরের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। অবশ্য তাহের জাসদ নেতাদের সম্মতির অপেক্ষায় থাকেননি। ওই দিন দুপুরেই তিনি সৈনিক সংস্থার সংগঠকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, মধ্যরাতে অভ্যুত্থান শুরু হবে।

অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য হলো
১. খালেদ মোশাররফ চক্রকে উৎখাত করা;
২. বন্দিদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করা;
৩. একটা বিপ্লবী মিলিটারি কমান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা;
৪. রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া;
৫. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা;
৬. বাকশাল বাদে অন্য সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন; এবং
৭. সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করা।

রাত ১২টায় শুরু হয় অভ্যুত্থান। প্রথম প্রহরেই জিয়া মুক্ত হন। ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই জিয়া-তাহেরের সমীকরণ ভেঙে যায়। ভোরে বেতারের বুলেটিনে সবাই জানতে পারেন, সিপাহি বিপ্লব হয়েছে এবং জিয়া মুক্ত হয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক-লরি ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকে। আমজনতা পথের পাশে দাঁড়িয়ে উল্লাস করে, হাততালি দেয় এবং অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো ট্যাংকে বা সেনাবাহিনীর ট্রাকে চড়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।

জাসদের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি যে ছিল না, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কয়েক শ সৈনিক ও জাসদ কর্মী একটি ট্যাংক নিয়ে ৭ নভেম্বর ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন জাসদ নেতা এম এ আউয়াল, মো. শাহজাহান ও মির্জা সুলতান রাজা। কারাগারে তখন শত শত জাসদ কর্মী। তাঁরা তিনজন সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনারা অপেক্ষা করুন। আমরা বাইরে গিয়ে পরিস্থিতিটা দেখি।’ তাঁরা আর ফিরে আসেননি। ওই কর্মীরা অনেক দিন কারাবন্দী ছিলেন।

কেউ দুই বছর, কেউ তিন বছর, কেউবা তার চেয়েও বেশি।

যারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, ‘বিপ্লব’ তাদের কাছে ধরা দেয় না। জাসদ ছিল দোটানায়। ফলে তাদের কাছে ৭ নভেম্বর থেকে গেল সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে। বিপ্লবটা আর হলো না। সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি জিয়া। তিনি জানতেন, ওই সময় ক্ষমতার নিয়ামক হলো সেনাবাহিনী এবং তিনি তার প্রধান। দু-তিন দিনের মধ্যেই তিনি নিজের অবস্থান মজবুত করে ফেললেন। জিয়াপন্থীদের কাছে ৭ নভেম্বর হলো ‘বিপ্লব ও সংহতি’র প্রতীক।

তাহের ক্ষমতার লড়াইয়ে ছিটকে পড়লেও নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ তাহের সরাসরি জিয়ার সঙ্গে সংঘাতে গেলেন। তিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলেন এবং একই সঙ্গে জিয়ার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাসদকেও ডোবালেন। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল স্বস্তি এবং শান্তি। তারা অস্থিরচিত্তের তাহের ও জাসদের পক্ষে দাঁড়ায়নি।

জিয়া-তাহেরের এই ‘বিপ্লব’ ছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। ৭ নভেম্বর সকালে বন্দী অবস্থায় খালেদ নিহত হলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর দুজন সহযোগী কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারও নিহত হন। এই তিনজনই ছিলেন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের স্মরণে ওই দিনটি অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করেন।

ক্ষমতার ত্রিভুজ লড়াইয়ে জিয়া-তাহেরের সম্মিলিত শক্তির কাছে খালেদ হেরে গিয়েছিলেন। পরে জিয়া-তাহেরের মধ্যকার দ্বন্দ্বে তাহের ছিটকে পড়েন। ২১ জুলাই ১৯৭৬ একটা সাজানো মামলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ক্ষমতার মূল লড়াইয়ে আবেগ বা মান-অভিমানের কোনো জায়গা নেই। হেরে গেলে মূল্য দিতে হয়, এটাই চরম সত্য।

সৈনিক সংস্থার সংগঠকেরা অনেকেই গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ আত্মগোপন করেন। এঁদের সামনের কাতারের নেতা করপোরাল আলতাফের অনুপস্থিতিতে তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার একটা গ্রামে টাঙ্গাইলের গণবাহিনী কমান্ডার খন্দকার আবদুল বাতেনসহ একদল কৃষকের সঙ্গে সভা করার সময় পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে তিনি নিহত হন। খন্দকার বাতেন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আলতাফের লাশ পাওয়া যায়নি। বাতেন পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছিলেন।

সৈনিক সংস্থার মাঠপর্যায়ের সংগঠকদের কেউ খোঁজ রাখেনি, এমনকি জাসদও না। এ দেশে মেজর-কর্নেল-জেনারেলরাই নায়ক হিসেবে নৈবেদ্য পান। কর্পোরালদের কেউ মনে রাখে না।

ধন্যবাদ

x

প্রত্যুত্তর দিন

লিঙ্ক ইমো ছবি ছবি ভিডিও
ছবি আপলোড

    A PHP Error was encountered

    Severity: Notice

    Message: Undefined variable: smiley_table2

    Filename: views/detail.php

    Line Number: 598

    কপিরাইট 2014.
    সকল স্বত্ব সংরক্ষিত