নন্দিত নিন্দিত মওদুদ আহমেদ
তিনি শুধু রাজনীতিবিদ নন। তারও বেশি কিছু। কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত। সদালাপী, সুদর্শন ও ঠাণ্ডা মেজাজের অধিকারী। সংসদে যার উপস্থাপনা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সাবলীল। লেখালেখির ক্ষেত্রে ঋজু ও ধারালো। মঞ্চের আড়ালে তিনি সীমাহীন রহস্যময়। বাংলাদেশের রাজনীতির এক অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র।
এক অনন্যসাধারণ কুশীলব। বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসজুড়ে তার উপস্থিতি ব্যাপক। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তিন সরকারের আমলেই ছিলেন ক্ষমতার নিউক্লিয়াসে। আপনি তার সমালোচনা করতে পারবেন। কিন্তু তাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। তিনি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশি নির্যাতনের পর ঠাঁই হয়েছিল কারাগারে। এই ঘটনা মনের অজান্তেই তাকে করে তোলে রাজনীতি সচেতন। ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির নেতা ছিলেন। পেশাজীবী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে নানা ভূমিকায় নিজেকে রেখেছিলেন রাজনীতির কক্ষপথেই।
বিএনপি আর জাতীয় পার্টি গঠনে পালন করেছেন মুখ্য ভূমিকা। কারাভোগ করেছেন পাকিস্তান আমল, বঙ্গবন্ধু, এরশাদ, ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট সরকারের আমলে। ওয়ান ইলেভেনের সময় মওদুদের মুক্তি চেয়ে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদকে চিঠি লিখেছিলেন অস্ট্রেলীয়-বৃটিশ সাংবাদিক ও লেখক জন পিলজার। গ্রানাডা টিভির হয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ কাভার করতে এসে ব্যারিস্টার মওদুদের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল যার।
কৃতী শিক্ষাজীবনের অধিকারী ব্যারিস্টার মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাস করে বৃটেনের লন্ডনের লিঙ্কন্স্? ইন থেকে অর্জন করেন বার-অ্যাট-ল। দেশে ফিরে হাইকোর্টে ওকালতির একপর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন আইনি লড়াইয়ে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করতে খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসিকে বাংলাদেশে আনতে রেখেছিলেন ভূমিকা।
১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান আহূত গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠকের ভূমিকা ছাড়াও ব্যারিস্টার মওদুদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল নিয়োগ করে মুজিবনগর সরকার। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকে কারাভোগ করতে হয়েছে তাকে।
নানা ঘটনাপরম্পরার মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭৭ সালে মওদুদ আহমদ দায়িত্ব পান উপদেষ্টার। বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে গঠিত জাগদলের ১৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। পরে জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে বিএনপি গঠিত হলে সে কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মওদুদ আহমদ। ১৯৭৯ সালে তিনি জিয়াউর রহমান সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। কর্মসূচির বিরোধিতা করাসহ নানা কারণে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন জিয়া। বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। অন্যদিকে দলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ৮৫ সালের ২৫শে জুন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃৃত হন মওদুদ আহমদ।
এরশাদ আমলের প্রথম দিকে তিনি ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই এরশাদ সরকারে যোগ দিয়ে মন্ত্রীত্ব পান। সেই সঙ্গে জাতীয় পার্টি গঠনে পালন করেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা। ১৯৮৫ সালে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী, ৮৬ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী, ৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব পালন করেন। ৮৯ সালে তিনি উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ পান। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর এরশাদ সরকার জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে কিছু সময়ের জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন এবং পরবর্তী অস্থায়ী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১-এ এমপি নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। ২০০১ সালে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত ও আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ৮ম জাতীয় নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলে পরে বগুড়ায় খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া আসন থেকে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন।
দীর্ঘ দিন রাজনীতির ময়দানে থাকা মওদুদ আহমদের বিশ্বস্ততা নিয়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তারবার্তায় তাকে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘আউটার সার্কেলের’ মানুষ হিসেবে। তবে নিজস্ব কৌশলে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ উতরে গেছেন মওদুদ আহমদ। রাজনীতিবিদ মওদুদের প্রচুর সমালোচনা থাকলেও লেখক মওদুদ আহমদ সব সময়ই প্রশংসিত। জেলে বসে নিজেকে রাজনৈতিক লেখায় নিয়োজিত রাখার যে ধারা তিনি চালু করেছেন তা বিরল।
তিনি রচনা করেছেন এক ডজনের বেশি বই। যার মধ্যে রয়েছে- ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ : এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি’, ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ’, ‘সাউথ এশিয়া: ক্রাইসিস অব ডেভেলপমেন্ট দি কেস অব বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব দ্যা ডেমোক্রেটিক রেজিম’ ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ১৯৯১ থেকে ২০০৬’, ‘চলমান ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা’, ‘কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮’, ‘সংসদে যা বলেছি’, ও ‘ইন লাভিং মেমোরি অব আমান মওদুদ, হিজ লাইফ অ্যান্ড আর্ট’।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নেপথ্য ঘটনাপরম্পরা বিশ্লেষণে তার প্রতিটি বইই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক ও লেখক সত্তার বাইরে তিনি একজন শিক্ষকও। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউস, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফায়ার্স, ফেয়ারব্যাংক এশিয়া সেন্টার এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান ইনস্টিটিউটের ফেলো। তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফায়ার্সের ভিজিটিং প্রফেসর।
১৯৪০ সালের ২৪শে মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ রাজনৈতিক। পিতা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও মা বেগম আম্বিয়া খাতুনের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তার পিতা ছিলেন একজন শিক্ষক। আর তার শ্বশুর হলেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। তার স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও সাবেক এমপি। তিনি এক পুত্র ও এক কন্যার জনক। ২০১৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেয়ার পথে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যুবরণ করেন তার একমাত্র পুত্র আমান মমতাজ মওদুদ।