সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে যারাই কোন কাজ করছে তাদেরই আটকে দিচ্ছে ফেসবুক। কোন প্রতিষ্ঠানকেই বিকশিত হতে দিচ্ছে না ফেসবুক। যারাই কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে হয় তাদের উদ্যোগ দখল করে নিচ্ছে। জোরপূর্বক কিনে নিচ্ছে। আর যারা বিক্রী করতে রাজি নয় তাদের আইডিয়া নকল করে সেসব সুবিধা ফেসবুকে দেয়ার মাধ্যমে তাদের পথে বসিয়ে দিচ্ছে।
হোয়াটসঅ্যাপ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন। ২০০৯ সালে জ্যান কউম ও ব্রায়ান অ্যাক্টনের হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছিল হোয়াটসঅ্যাপ। বার্তা আদান–প্রদানের ক্ষেত্রে ফেসবুকের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার সব সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ১ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে হোয়াটসঅ্যাপকে অধিগ্রহণ করে নেয় ফেসবুক। মাত্র চার বছরের মধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপের সঙ্গে ফেসবুকের ঝামেলার সুর শোনা যাচ্ছে। নিজের প্রতিষ্ঠা করা হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সরে যেতে হচ্ছে এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জ্যান কউমকে। অবশ্য এর আগেই ফেসবুকের অধীনে থাকা হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়েছেন আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা অ্যাক্টন। এখন তাঁরা ফেসবুকবিরোধী প্রচার চালাচ্ছেন।
এবার আসি ফোরস্কয়ার নিয়ে। মোবাইল লোকেশনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফোরস্কয়ারের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাভিন সালভাদুরি মনে করেন, ২০১০ সালে তাঁর কোম্পানিসহ সামাজিক যোগাযোগের কয়েকটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান, যেমন: টুইটার, টাম্বলার, পাথের পক্ষে ফেসবুকের সমকক্ষ হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল। কিন্তু ফেসবুকের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। ওই বছরেই ফেসবুক ‘চেক ইন’ নামের একটি ফিচার আনল, যাতে কোনো স্থানে গেলে তা চিহ্নিত করা যায়। এটি ছিল ফোরস্কয়ার অ্যাপের প্রধান ফিচার, যা সরাসরি নকল করে বসল ফেসবুক।
ফোরস্কয়ারের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাভিন সালভাদুরি
কী করার ছিল এই উদ্যোক্তাদের? এর জবাবে সালভাদুরি ফেসবুকবিরোধী একটি জোটে নাম লেখালেন। তিনি পাথ, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে আলোচনা করলেন। এই উদ্যোগগুলো সরাসরি ফেসবুকের হুমকির মুখে ছিল। এসব উদ্যোগের সব মূল ফিচারই নকল করে ফেসবুকে আসার হুমকি ছিল। সালভাদুরি বলেন, ‘এটা খুব কমন কথা! ফেসবুক তখন কোনো প্রতিষ্ঠানকে বলত যে আমাদের সঙ্গে যোগ দাও, তা না হলে আমরা তোমার নকল করে ছেড়ে দেব।’
সালভাদুরির মতে, উন্মুক্ত ইন্টারনেটের বদলে দেয়ালঘেরা বাগান গড়ে তুলেছিল ফেসবুক। যাকে তারা পছন্দ করত না, তার ক্ষতি করত। যা লাখো মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম—এমন বিষয়গুলোকে তারা নিজেদের করে নিত। এর বিপক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন সালভাদুরি ও ফেসবুকবিরোধী জোটের উদ্যোক্তারা।
সাম্প্রতিক কালে ফেসবুকের নকলের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে স্ন্যাপচ্যাট। স্ন্যাপচ্যাটের স্টোরিজ ফিচারটি এর উদাহরণ হতে পারে। অনেক দিন ধরেই স্ন্যাপচ্যাটকে বাগে আনার চেষ্টা করেছেন জাকারবার্গ। ২০১৩ সালে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার দিয়ে স্ন্যাপচ্যাট কিনতে চেয়েছিল ফেসবুক। কিন্তু মার্ক জাকারবার্গের কাছে নিজেদের বিক্রি করতে রাজি হননি স্ন্যাপচ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ইভান স্পিগেল। বরং আকর্ষণীয় সব ফিচারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলেন ফেসবুককে। এরপরই শুরু হয় স্ন্যাপচ্যাটের নানা বিষয় নকল করার কাজ।
২০১২ সালেই মাত্র ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে ইনস্টাগ্রামকে কিনে নেয় ফেসবুক। পরেই বছরেই ১১০ কোটি মার্কিন ডলারে টাম্বলারকে কিনে নেয় ইয়াহু। পাথের জনপ্রিয়তায় ধস নামে এবং পরে বিক্রি হয়ে যায়। ফোরস্কয়ার স্বাধীন থাকলেও এর অ্যাপটি দুভাগ করে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কোনোরকমভাবে এগিয়ে চলেছে।
২০১২ সাল থেকে যেসব সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপ জনপ্রিয় হওয়া শুরু করছিল, তা থেকেই নকল করার অভিযোগ রয়েছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। এরপর তো ইনস্টাগ্রাম কিনে নেওয়া বা হোয়াটসঅ্যাপকে অধিগ্রহণ করার বিষয়টি সামনে এল। ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারে স্ন্যাপকে কিনতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কমপক্ষে ১০ বার এর মূল ফিচারগুলো নকল করেছে ফেসবুক। এমনকি কিশোরদের উপযোগী অ্যাপ টিবিএইচকেও ছাড় দেয়নি।
ফেসবুক তার সম্ভাব্য শত্রুর খোঁজ ঠিকই রাখে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোন অ্যাপ ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে বা কোন অ্যাপকে কিনে নিতে হবে, তা ঠিক করার একটি উপায় ফেসবুকের হাতেই আছে। ২০১৩ সালে ফেসবুক অনাভো নামের একটি ইসরায়েলের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কিনেছিল। ওই উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটি এমন একটি অ্যাপ তৈরি করেছে, যা মোবাইল তথ্য ব্যবহার পরিমাপের সুযোগ দেয়। ফেসবুক অনাভোকে কেনার পর ওই লাখো ব্যবহারকারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে কোন অ্যাপ জনপ্রিয় হচ্ছে, শুরুতেই তার একটি ধারণা পায় ফেসবুক। অনাভোর তথ্য-উপাত্ত দেখেই ফেসবুক কর্তৃপক্ষ হোয়াটসঅ্যাপসহ লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা পেরিস্কোপ ও মিরাক্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নেয়।
অবশ্য, ফেসবুককে একাধারে দোষারোপ করা ঠিক নয়। সিলিকন ভ্যালির সব বড় প্রতিষ্ঠান ছোট ছোট উদ্যোগকে গেলার জন্য বসে আছে। আমাজন আর গুগলের কথা না বললেই নয়। তবে লক্ষ্য নির্ধারণের গতিতে ফেসবুকের ধারেকাছে নেই তারা। ফেসবুকের অর্থ খরচের ইচ্ছা ও প্রকাশ্যে নকলের ক্ষেত্রে অন্যরা পিছিয়েই বলা চলে।