আর হয়ত জীবিত ফিরতে পারবো না
আর হয়তো জীবিত ফিরতে পারবো না এই কথাটা মানুষ কখন বলতে পারে? গত পাঁচ বছরে দেশে যার সাথেই সরকারের সাথে টক্কর লেগেছে তারাই হারিয়ে গেছে। এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেমন আছে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ। তেমনি আছে সরকারি ক্ষমতাসীন দলের মানুষরাও। যে বা যাদেরই সরকার হুমকি মনে করে সে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লোক হলেও রক্ষা নেই।
আসছি কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে। সরকার চেয়েছে ছাত্রলীগ ও পুলিশ দিয়ে হুমকি দিয়ে আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হলেও শেখ হাসিনা হেরে যাওয়ার মানূষ নয়। তাই সে আন্দোলনকারী নেতাদের শায়েস্তা করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। হাসিনার ১১ এপ্রিলের সংসদে দেয়া বক্তব্যের শেষেই চারটি মামলা হয় ছাত্রদের বিরুদ্ধে।
এই মামলাগুলোতে এখনো পর্যন্ত কাউকে এরেস্ট না করলেও আন্দোলনকারী নেতাদের হেনস্তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে আজ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আন্দোলনকারী একজন নেতাকে শিবিরের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করে রিপোর্ট করা হয়েছে। এদেশে কাউকে জঙ্গি, শিবির ইত্যাদি ট্যাগ দিতে পারলেই তাকে গুম করা বৈধতা পেয়ে যায়।
ইত্তেফাকের রিপোর্টের প্রতিবাদে ও মামলা প্রত্যাহারের জন্য আজকে আন্দোলনকারীরা বেলা ১১ টায় সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুরের খাবার খেতে গেলেই তিনজন নেতাকে অপহরণ করে ডিবি পুলিশ। ওই তিনজন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর এই তিনজনকে পুলিশ ছেড়ে দেয়। পরে অবশ্য পুলিশ বলছে, তাঁদের তুলে নেওয়া হয়নি, বরং আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছিল। আলোচনার জন্য এভাবে টেনে হিঁচড়ে নিতে হয় এমন পদ্ধতি কারো জানা ছিল না।
আন্দোলনকারী সংগঠনের ওই তিন যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র নুরুল্লাহ নূর, এমবিএর (ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ) ছাত্র রাশেদ খান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ফারুক হোসেন। আজ বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে পরিষদ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আগামী দুই দিনের মধ্যে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে ওই তিনজনই উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে রাশেদ খান বক্তব্যে তাঁকে জামায়াত–শিবিরকর্মী হিসেবে ইত্তেফাকে করা প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানান।
ওই তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে রিকশা থেকে নামিয়ে একটি বড় মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী আরেক নেতা ও এক দোকান কর্মচারী। পরে যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানও বলেন, তাঁদের তুলে নেওয়া হয়।
যদিও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, তিনজনকে তুলে নেওয়া হয়নি। তাঁদের আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছে। হয়তো এতক্ষণ চলেও গেছেন। পরে বেলা পৌনে তিনটায় রাশেদের মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরে পৌনে তিনটার দিকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, তাঁর বাবাকেও থানায় নেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী পরিষদের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন ঘটনা সম্পর্কে জানান, সংবাদ সম্মেলন শেষে বেলা পৌনে একটার দিকে তাঁরা কয়েকজন দুপুরের খাবার খেতে রিকশায় করে চানখাঁরপুল যাচ্ছিলেন। রাশেদ, নুরুল্লাহ ও ফারুক এক রিকশায় ছিলেন। আর তিনি ছিলেন পেছনের রিকশায়। ওই তিনজনকে বহনকারী রিকশাটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশের ফটকের কাছে এলে পেছন থেকে তিনটি মোটরসাইকেল রিকশাটির সামনে গিয়ে গতিরোধ করে। পরে পেছন থেকে আরেকটি সাদা রঙের হাইএস মডেলের মাইক্রোবাস এসে সেখানে থামে। গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে রিকশা থেকে তিন নেতাকে নামিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়।
একই তথ্য জানালেন আরেক প্রত্যক্ষদর্শী হাসপাতালের ফটকের উল্টো দিকে খাবারের দোকানের কর্মচারী মো. সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল ও গাড়ি থেকে নেমে সাত-আটজন ওই রিকশার সামনে দাঁড়ায়। তারা তিনজনকে রিকশা থেকে নামাতে গেলে কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়। পরে তিনজনের প্রত্যেককে দুপাশ থেকে দুজন করে ধরে গাড়িতে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে যায়।
এর আগে সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুর ১২ টার দিকে রাশেদ খান প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা শাহবাগ থানায় যাবেন। তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এ ব্যাপারে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করবেন। তুলে নেওয়ার পর তিনজনের ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়।
তিন নেতা আটক করে সরকার মূলত ভয় দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারিরা খুব দ্রুতই রাস্তায় নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিতে যাওয়ায় সরকার এই প্রজেক্টে আবারো পিছু হটলো। বাধ্য হলো নেতাদের ছেড়ে দিতে। সেই সাথে ইত্তেফাক পত্রিকাও ক্ষমা চেয়েছে ভুল রিপোর্ট করার জন্য। তারা অনলাইন থেকে তাদের রিপোর্ট সরিয়েও নিয়েছে।
পুলিশ ছেড়ে দেয়ার পর তিন নেতা আবারো সংবাদ সম্মেলন করেন। সোমবার (১৬ এপ্রিল)দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আমরা একটি রিকশায় করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আন্দোলনকারী আহত ছাত্রদের দেখতে যাই। কিন্তু হাসপাতালের সামনে পৌঁছা মাত্র আমাদের রিকশা থেকে জোর করে নামিয়ে চোখ বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে কালো কাচ দেওয়া সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দাবি করেছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন যুগ্ম আহবায়ক দাবি করেছেন রাশেদ খান, নুরুল হক এবং ফারুক হোসেন।
তারা বলেন,‘কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সারাদেশে কমিটির নেতারা সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে,আমাদের ওপর জীবননাশের হুমকি আছে। শুধু তাই নয়, আমাদের পরিবারও হুমকির মুখে আছে।
যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক বলেন, ‘আজ ১২ টার পরে সংবাদ সম্মেলন শেষে ঢাকা মেডিকেলে আহত আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে দেখতে যাই। যখন মেডিক্যালের (হাসপাতালের) ইমার্জেন্সি গেটে পৌঁছাই তখন কালো গ্লাসের দুটি হায়েস গাড়ি ও কয়েকটি মোটর সাইকেলে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন আমাদের আটকিয়ে রিকশা থেকে নামিয়ে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে।
কেন্দ্রীয় তিন নেতাকে তুলে নেওয়ার প্রতিবাদে মিছিল করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা
পরে আমাদেরকে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। তখন তারা আমাদেরকে বলে, আমাদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হবে। ভিডিও দেখানো হবে। কিন্তু নিয়ে গিয়ে কিছুই বলেনি। কোনও কথা জানতেও চাওয়া হয়নি, ভিডিও দেখানো হয়নি। শুধু বলেছে, আমাদের ওপর নাকি হামলার আশঙ্কা ছিল, তাই তুলে নিয়ে আসছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে যদি তথ্য নেওয়ার প্রয়োজন থাকতো তাহলে আমাদেরকে ডাকলে স্বেচ্ছায় যেতাম। কিন্তু, এভাবে চোখ বেঁধে তুলে নেওয়ার কারণ কি?’
তিনি বলেন,‘আমাদেরকে তুলে নেওয়ার সাথে সাথেই ভেবেছি আর হয়ত জীবিত ফিরতে পারবো না।’ ছেড়ে দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমদের সঙ্গে থাকা কয়েকজন আমাদেরকে তুলে নেওয়া দেখে ফেলেছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াতে নিউজ হওয়ার ঘটনায় তারা তোপের মুখে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। না হলে হয়ত আজ আমরা পৃথিবীর আলো আর দেখতে পেতাম না।’
নুরুল হক আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা বাতিলের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তাকে স্বাগত জানিয়ে আমরা আনন্দে মিছিল করে আন্দোলন স্থগিত করেছিলাম। কিন্তু তারপরেও আজ আমাদের তুলে নিয়ে প্রাণনাশের হুমকিসহ বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমি এ ঘটনার নিন্দা জানাই।’
রাশেদ খান বলেন, ‘আজ আমাদরকে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবাকে ঝিনাইদহ সদর থানায় নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে। তাকে দিয়ে জোর করে স্বীকার করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে আমি শিবির করি, আমার বাবা জামায়াতের লোক। কিনন্তু,আজ যদি সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমি ন্যায্য দাবি করি তাহলে এভাবে হয়রানি কেন করা হবে? আমি কি আমার অধিকার চাইতে পারি না? আমি কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নই। তাহলে কেন শিবির আপবাদ দেওয়া হবে? আজ আমরা হুমকির মুখে, আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে।